সেমিস্টারের বেতন দেয়ার দিনগুলো একটু বিরক্তিকরই হয় সবসময়। এই বিল্ডিং থেকে সেই বিল্ডিং, হল থেকে ডিপার্টমেন্ট, ব্যাংক থেকে প্রশাসনিক ভবন। সারাদিন এইভাবে দৌড়ের উপর থাকতে হয়। এত ঝামেলার মধ্যে নতুন ঝামেলা হলো আসন্ন সেমিস্টারের বেতন দেয়ার তারিখ নোটিশ বোর্ডে চলে এসেছে, আর আমি রেডি হতে গিয়ে দেখি আমার বেতন বইয়ের পৃষ্টা শেষ। নতুন বেতন বই নিতে সকালে উঠেই হাজির হলাম প্রশাসনিক ভবনে। কর্মকর্তার টেবিলের সামনে বেতন বই নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আশে পাশে আরো কয়েকজন আছে। ডান দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। অসম্ভব সুন্দরী এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কর্মকর্তার সাথে কথা বলছে। কথা শুনে বুঝলাম আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তির জন্য এসেছে। আমি মেয়েটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছিলাম না। বারবার ফিরে তাকাচ্ছিলাম। মেয়েটার নাম জানতে একটু চালাকির চেষ্টা করে ডান দিকে সরে গেলাম, আড়চোখে তাকালাম তার বেতন বইয়ের দিকে। ঠিকমত দেখতে পেলাম না।
আমি যে মেয়েটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলাম তা সে খেয়াল করেছে। হঠাৎ সে আমার দিকে ফিরে তাকালো। আমি তো তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। চোখ সরালাম না। সে চরম বিরক্তি নিয়ে আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। কর্মকর্তা আমার দিকে তাকিয়ে বললো—তোমার কি লাগবে?
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই বললাম—নতুন একটা বেতন বই দেন।
--কোন ডিপার্টমেন্ট?
--BAD…
--একটু অপেক্ষা করো, এই কাজটা সেরে নেই।
ব্যাড বলার সাথে সাথেই মেয়েটা আমার দিকে ঘুরে তাকালো। তার চোখে রাগ ভরা। কর্মকর্তা বুঝতে পেরেছে আমি বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টের (BAD) কথা বলেছি। মেয়েটা বোঝেনি। আমি একটু হেসে দিলাম, শয়তানী হাসি। হঠাৎ পিঠে হাত পড়লো কার যেন। ফিরে দেখি বন্ধু হিরা দাঁড়িয়ে আছে।
হিরা দ্রুত ভঙ্গিতে বললো—কি রে, বেতন বই নেয়া হইছে তোর? ব্যাংকে আগে আগে না গেলে তো সিরিয়াল পাবি না... জলদি কর...
আমি হিরার কথা শুনেও না শোনার ভান করে ওকে পালটা প্রশ্ন করলাম—দোস্ত, do you know what is the most beautiful sentence in the world?
হিরা বললো—আরে ব্যাটা, ইংলিশ কম ঝাড়। বাংলায় বল।
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম—I Love You…
কথাটা শোনার সাথে সাথে মেয়েটা রক্তচক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকালো। তার চোখ বিশ্বাস করতে পারছে না আমি এই কথাগুলো বলেছি। অবাক আর রাগ দুটোই ভেসে উঠলো তার চোখে। আমার মুখে হাসি, ঠোটের কোণের মুচঁকি হাসি।
হিরা বললো—বুঝছি, সকালে তোর নাস্তা হয় নাই। পেট খালি তাই আবোল তাবোল বকতেছিস। চল আমার সাথে। আগে খাবি, তারপর সব কাজ।
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়েই বললাম—না রে দোস্তো, দুনিয়াটা অনেক সুন্দর। দুনিয়ার মানুষগুলো আরো সুন্দর।
অফিসের কর্মকর্তা মনে হয় এবার একটু বিরক্ত হলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—এই, তুমি যাও তো এখান থেকে।
আমি বললাম—আমার বেতন বই দেন, চলে যাচ্ছি।
লোকটা কোন কথা না বলে জলদি একটা বেতন বই বের করে আমাকে দিলো। আমি হাতে নিয়েই তার দিকে ঝুকে গিয়ে লোকটার হাতে থাকা মেয়েটার বেতন বইটা ছিনিয়ে নিলাম। ঘটনার দ্রুততায় সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। আমি বেতন বইটা হাতে নিয়ে মেয়েটার নাম আর আইডি জোরে শব্দ করে পড়লাম। সাথে সাথে মেয়েটা আমার হাত থেকে তার বেতন বই ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। শোধবাদ। আমি ছিনিয়েছিলাম, সেও ছিনিয়ে নিলো।
মেয়েটা, যার নাম অর্থী রহমান, রাগান্বিত কন্ঠে চেঁচিয়ে বললো—আপনার সাহস তো কম না... কি মনে করেন নিজেকে? ভার্সিটির সিনিয়ার হইছেন বলে কি সব কিনে নিছেন নাকি? মাস্তানি করেন? এই আপনার নাম কি বলেন? দেখাচ্ছি আপনার মাস্তানি। চেনেন আমাকে !! কি হলো, কথা বলেন না কেন?
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম, বোকার মত মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কি বলবো বুঝতে পারছি না। মেয়েটা যে এমন রিএকশান দেখাবে বুঝতে পারিনি। পিছন থেকে হিরা আস্তে আস্তে বললো—দোস্ত, এখনো সময় আছে, চল কেটে পড়ি।
আমি মেয়েটাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললাম—ইয়ে মানে.........
বলেই হিরাকে সাথে নিয়ে দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে ব্যাংকে পৌছে গেলাম। ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে হাফাচ্ছি দুজনে। হাফাতে হাফাতেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম দুজনের। আমার এই বন্ধুটা আমাকে কখনো ছেড়ে যায়নি। এই শালার সাথে কত ধরনের শয়তানি করি, কত ঝগড়া বাধে, তারপরও আবার ফিরে আসি। এই হারামীরে সাথে নিয়ে একটু আগে যেমন দৌড় দিলাম, এরকম অনেক ধরনের দৌড় আগেও দিছি। এই ব্যাটার পরানটা সারাদিন ভয়তে লাফায়।
যাই হোক, বেতনপর্ব শেষ হয়ে ২-৪ দিন পার হয়ে গেছে। সকালের ক্লাস মিস করে ১২ টার দিকে তপন দাদার চায়ের দোকানে হাজির হলাম। বাইকটা পার্ক করে আয়েশ করে হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে দোকানের দিকে তাকাতেই দেখি আমার থেকে ১০ ফিট সামনের বেঞ্চে অর্থী বসে আছে। আমাকে দেখে পাশে বসা একটা ছেলেকে যেন কি বললো। ছেলেটা আমার দিকে হাত ইশারা করে ডাকলো। আমি পিছনে তাকিয়ে কাউকে না দেখে আবার সামনে তাকিয়ে ঐ ছেলেটার উদ্দ্যেশ্যে বললাম—আমি?
ছেলেটাও আঙ্গুল দিয়ে আমাকে ইঙ্গিত করলো—হ্যা, হ্যা, তুমিই।
আমি বোকাবোকা বেশ ধারণ করে সামনে এগিয়ে গেলাম। আমি ছেলেটার সামনে দাড়াতেই ছেলেটা আমাকে বললো—এই ছেলে, তুমি অর্থীকে কি বলেছো?
আমি বললাম—ইয়ে মানে, ভাইয়া... হইছে কি...
--হইছে কি মানে? কি হইছে?
--কিছুই হয় নাই ভাই। ক্রাশটা একটু বেশি জোরে খাইছিলাম তো আর কি।
কথাটা শোনার সাথে সাথে অর্থী লাফ দিয়ে উঠে দাড়ালো। ছেলেটাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো—দেখছো ভাইয়া, কত্ত বড় সাহস!! এরপরও কথা বলে...
ছেলেটা অর্থীকে থামিয়ে দিয়ে বললো—তুমি বসো তো, আমি দেখতেছি।
এবার ছেলেটা আমার দিকে ফিরে বললো—হু, কি বলতেছিলি যেন? “জোরালো ক্রাশ” খাইছিস? এইটা তোর কত নম্বর ক্রাশ ছিলো রে?
আমি বললাম—ভাইয়া, আপনি তো সবই জানেন। এইটা আমার ১৪২ নম্বর, এইটাই শেষ ভাইয়া। আর হবে না, প্রমিজ।
অর্থী আমার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুসছে। কিছু বলতে পারছে না। ছেলেটা এবার আমাকে বললো—শালা, তুই কি টাইপের মানুষ বল তো? এত এনার্জি কই পাস? নাহ, আমি তোর সাথে পারবো না। তা র্যানগ দিবি ভালো কথা, আগে কইতি, একসাথে যাইতাম। একা একা দিছিস, মেয়েতো রেগে ফায়ার। আমার কাজিন হয় রে। তুই আমার দোস্ত না হইলে তোর আজকে খবর ছিলো রে।
আমি বললাম—ধুর ব্যাটা, তুই র্যা গ দিতে পারিস নাকি? আর তোর কাজিন হয় তো আমার তাতে কি? আমি কাউরে ভয় পাই নাকি? তুই আমারে চিনিস না?
হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে ছেলেটার সাথে হ্যান্ডশেক করে কোলাকুলি করলাম। ছেলেটা আর কেউ না, আমার কলেজ জীবনের বন্ধু কৌশিক। আর্কিটেকচারে পড়ে। আমাদের কথা শুনে অনামিকা হা করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। রাগ আর অবাক দুটোই তার চোখে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার সামনের বেঞ্চে বসলাম। অর্থীর দিকে তাকিয়ে কৌশিককে বললাম—তা তোর কাজিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি না?
কৌশিক আমাকে অর্থীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে আমি বললাম—কালকের কান্ডে কিছু মনে করো না। তোমাকে ভালো লেগে গেছে। কিচ্ছু করার নাই। মাথা নষ্ট বলতে পারো।
এবার অনামিকা অবাক হয়ে বললো—আপনি কি পাগল নাকি বলেন তো? কালকে ঐ কাজ করেছেন, আজ এইসব বলছেন...
--পাগল বলতে পারো। আমি এরকমই। আর হ্যা, কালকের জন্য কোন স্যরি টরি বলতে পারবো না। তোমাকে আমার ভাললেগেছে মানে যে আমাকেও তোমার ভাল লাগতেই হবে এমন কোন কথা নেই।
কথাগুলো বলে আমি উঠে এলাম সিগারেট ধরাতে। অর্থী আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। সে আসলে কি বলবে বুঝতে পারছে না। বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে আছে সে। আমাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো—এই যে, শোনেন...
আমি তার দিকে ফিরে বললাম—শোনার মত সময় এখন নেই। পরে যদি কখনো দেখা হয়, তখন শুনবো।
কথাগুলো বলেই বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে আসলাম।
এরপর থেকে শুরু হয় আমার ফাইজলামি। অর্থী আমার ১৪২ নম্বর ক্রাশ কথাটা ভুল। সিরিয়াস কোন রিলেশনশিপে আমি কখনো যাইনি। অনেককেই ভাল লাগলেও কাউকে অর্থীর মত মনে ধরেনি। তাই একটু বেশীই গায়ে ঘেসার চেষ্টায় থাকলাম। ভার্সিটির ভিতরে ফুল বিক্রি করা এক পিচ্চিকে ঠিক করলাম। প্রতিদিন একটা করে লাল গোলাপ অর্থীকে দিয়ে আসবে। কয়েকদিন নিজে লুকিয়ে গোলাপ দেয়ার ঘটনাটা দেখলাম। গোলাপ দেয়ার পর অর্থী “কে দিয়েছে” জিজ্ঞাস করলে ঐ পিচ্চি আমার নাম যখন বলে তখন অর্থী চারিদিকে ঘুরে তাকিয়ে আমাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু পায় না। আমি হাসি।
বিজনেস আর আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট দুটোই একই বিল্ডিঙ্গে। কয়েকদিন পর আমি ক্লাস শেষ করে বিল্ডিঙ্গের মেইন গেট দিয়ে বের হচ্ছি। হঠাৎ অর্থী কোথা থেকে যেন আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, কোমরে হাত, রাগান্বিত চেহারা। আমার দিকে তাকিয়ে বললো—ঐ মিস্টার, আপনি কি শুরু করছেন বলেন তো? চান টা কি বলেন তো?
আমি কোন কথা না আস্তে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম আমার বাইকের কাছে। বাইক স্টার্ট দিয়েছি তখনই অর্থী এসে আমার বাইকের চাবি খুলে নিয়ে দৌড় দিলো। আমি হতবম্ব হয়ে বাইকে বসে আছি। বাইক থেকে নেমে আমিও অর্থীর পিছনে দৌড়ানো শুরু করলাম। আমাকে আসতে দেখে অর্থী আরো জোরে দৌড় দিলো। আমি দৌড়ে তাকে ধরলাম।
—আরে, চাবি নিয়া তুমি কি করবা? ঐটা আমারে দিয়া যাও।
—আগে বলেন আপনি কি চান, নাহলে এই চাবি পাবেন না।
--চাবো আর কি !! আমার বাইকের পিছনের সিটের পার্মানেন্ট প্যাসেঞ্জার বানাতে চাই তোমাকে।
--ইশ... এত সোজা?
--সোজা না হইলে ব্যাকা তো হবে?
--এইরকম সস্তা ফুল দিয়ে আমার মন জয় করা যাবে না জনাব আগেই বলে দিচ্ছি।
--আমি অতো মন জয় টয় করার মধ্যে নেই। মন চাইলে আসো নাহলে আমি বিদায় নিলাম।
কথাটা বলে আমি অর্থীর হাত থেকে বাইকের চাবি কেড়ে নিয়ে চলে এলাম। বাইক স্টার্ট দিতে যাবো তখন টের পেলাম কে যেন বাইকের পিছনের সিটে উঠে বসলো। পিছনে তাকিয়ে দেখি অর্থী। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আমি।
অর্থী আমার দিকে তাকিয়ে বললো—এমন হা করে দেখার কিছু নেই। বেশি জোরে বাইক চালাতে হলে আমাকে আগে থেকে ওয়ার্নিং দিয়ে নিতে হবে বলে দিলাম। আর হ্যা, কোনদিন যদি শুনেছি বা দেখেছি এই সিটে অন্য কোন মেয়ে উঠেছে তাহলে কিন্তু সেদিনই খুন করে ফেলবো।
কথাগুলো বলে অর্থী আমার কাধে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে বসলো। আমি মুচকি হাসি দিয়ে বাইক চালাতে গিয়ে জোরে ব্রেক কষলাম। অর্থী আমার পিঠে ধাক্কা খেয়ে বুঝলো আমি ইচ্ছা করে এই কাজ করেছি। ও আমার পিঠে চড় দিলো, তারপর দুইহাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে বসলো।
আমি হাসতে হাসতে বাইকের স্পিড বাড়ালাম।
বাইক সামনের দিকে যাচ্ছে, জীবনেরও নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে।
লেখাঃ Muttaky Rahman Biswas
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন